রাফিহার বাবার কর্তৃক প্রদেয় তথ্য অনুসারে:
আমার নাম মোঃ তারিফুল হক। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছি। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর আমার মেয়ে রাফিহা আফসানা তাসফিয়া কুষ্টিয়া সদরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে জন্মগ্রহণ করে। চাকুরির সুবাদে আমি তখন চট্টগ্রাম জেলায় ছিলাম। মেয়ের জন্মগ্রহণের খবর শুনে ছুটি নিয়ে নিজ শহর কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করি। গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে সন্ধ্যা বেলায় রওনা হয়ে পরদিন সকালে কুষ্টিয়া পৌঁছায়। চলতি পথে আমার নিজের ভিতর অনেক রকম অনুভূতি কাজ করছিলো। প্রথম সন্তানের বাবা হয়েছি তাই খুব আবেগী হয়ে পরেছিলাম।
মোবাইলে ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে পরিবারের সদস্য ও অন্যান্যদের সাথে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাদের কথায় কেমন যেন বিষন্নতার ছাপ বলে মনে হচ্ছিল। অন্যদিকে সবাই বললো, খুব সুন্দর মেয়ে শিশুর জন্ম হয়েছে। মেয়ের ছবি দেখলাম। পরীর মতো ফুটফুটে মিষ্টি একটি মেয়ে, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
কুষ্টিয়াতে পৌঁছেই স্ত্রী ও মেয়েকে দেখতে ক্লিনিকে ছুটে গেলাম। মেয়ের পায়ের অবস্থা সম্পর্কে পরিবারের কেউ আমাকে তখনো জানায়নি। যখন নিজ চোখে দেখলাম ছোট্ট দুটি পা ভেতরের দিকে বাঁকানো তখন খুব হতাশ হয়ে পড়লাম।
সেই ক্লিনিকের ডাক্তার এবং নার্সরা আমাকে সান্তনা দিয়ে জানালেন পায়ের পাতা বাঁকার চিকিৎসা করলে মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি অনেককেই দেখেছি সঠিক চিকিৎসার অভাবে সুস্থ হতে পারেনি। বাঁকানো পায়ের পাতা নিয়ে তারা ভয়ংকর কষ্টে জীবনযাপন করছেন। আমার মেয়ের কথা চিন্তা করে আমার স্ত্রী ও পরিবারের অনেকই ভেঙ্গে পরেছিলো। কিন্তু আমি তো সৈনিক, এতো সহজে যদি ভেঙ্গে পড়ি তাহলে তো হবেনা।
২ দিন পর বাড়িতে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েকে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাবো। তবে রাতে মেয়ের চিন্তায় একদম ঘুম হয়না। আমার সীমিত ছুটিও শেষের পথে। রাত জেগে ইন্টারনেটে এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে থাকি। পরিশেষে ওয়াক ফর লাইফ ক্লাবফুট ক্লিনিকের সন্ধান পাই এবং রোগের নাম জানতে পারি ক্লাবফুট বা মুগুর পা। পরদিন সকালেই আমি কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ক্লাবফুট ক্লিনিকটির উদ্দেশ্যে রওনা হই। হাসপাতালের ক্যাম্পাসে একটা বড় আকারে বিলবোর্ড লাগানো ছিলো এবং সেখানে ক্লাবফুট বা মুগুর পায়ের চিকিৎসা বিষয়ে লেখা দেখতে পেলাম। বিলবোর্ডে চিকিৎসার তথ্যের জন্য যোগাযোগের একটি মোবাইল নাম্বার দেওয়া ছিল। সেই নাম্বারে কথা বলে বিস্তারিত জানানোর পর ওয়াক ফর লাইফ ক্লিনিকের ম্যানেজার ও ফিজিওথেরাপিস্ট আমাকে চিকিৎসার ব্যাপারে আশ্বস্থ করেন। পরবর্তী ক্লিনিকের দিন হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
ইতিমধ্যে আমার ছুটি শেষ হয়ে যায়। পরিবারের লোকজন ওয়াক ফর লাইফ ক্লাবফুট ক্লিনিকে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আমার মেয়েকে অন্তর্ভুক্ত করে দেন। ওয়াক ফর লাইফ ক্লিনিক টিমের সকল সদস্য অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বিশেষ করে অর্থোপেডিক সার্জন ও ফিজিওথেরাপিস্ট এর চিকিৎসায় ও সহযোগিতায় আমার মেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। আমার স্ত্রী এই চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে সর্বোচ্চ ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছে। কেননা ক্লাবফুট শিশুকে চিকিৎসা অবস্থায় যত্ন নেয়ার বিষয়গুলো অন্য সাধারণ শিশুদের থেকে কিছুটা ভিন্ন এবং কষ্টকর ছিলো। প্রতিদিন নিয়ম মেনে বিশেষ জুতা পরানো, কাপড় পরিবর্তন সবই ভিন্নভাবে করতে হতো। এছাড়া মেয়ের অসুস্থতা নিয়ে প্রতিবেশিদের কাছে নানা রকম কথা শুনতে হয়েছে। আমার স্ত্রী সবকিছুই ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করেছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ও ওয়াক ফর লাইফের নিরলস প্রচেষ্টায় আমার মেয়ে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। এখন আমার মেয়েকে দেখলে তার আগের অবস্থা বোঝার কোন উপায় নেই।
পরিশেষে আমি বলব প্রত্যেক অভিভাবকদের উচিত ওয়াক ফর লাইফ ক্লাবফুট ক্লিনিকে চিকিৎসা প্রদানকারী দলের সদস্যদের কথা ধৈর্য্য সহকারে মেনে চলা। তাদের প্রতিটি উপদেশ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আমি ও আমার পরিবারকে অণুপ্রেরনা যুগিয়েছেন। ওয়াক ফর লাইফের সকল সদস্য, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং পরিচালনা মন্ডলীর সকলের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ। নিরলস পরিশ্রম করা আমার স্ত্রীর প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমার মেয়ের সুন্দর শৈশব ও উজ্জ্বল আগামীর জন্য সকলে দোয়া করবেন। ধন্যবাদ।